$type=ticker$c=12$cls=0$b=0

যুদ্ধ মহামারি দুর্যোগে প্রবীণরাই বেশি ভোগে

হাসান আলী 

প্রবাদ আছে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। যে যত দুর্বল, তার ভোগান্তি তত প্রবল। সমাজটা গড়ে দিয়েছে দুর্বলরা এবং রক্ষা করেও দুর্বলরা। সেই দুর্বল মানুষরাই সবলের করুণা ও দয়ার প্রার্থী। সুবিধাবঞ্চিত মানুষরা দিনরাত পরিশ্রম করে আমাদের জীবনে আরাম-আয়েশ নিশ্চিত করে। আবার তারাই নানা রকমের দুঃখ-কষ্ট, নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হন।

এ যাবৎকালে যতগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, তার সবটাতেই নারী, শিশু ও প্রবীণরা সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত হয়েছে। নারী সম্ভ্রম হারিয়েছে এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। স্বামী, সন্তান, বাবা-মা, ভাই-বোনকে হারিয়ে অথৈ সাগরে হাবুডুবু খেতে হয়েছে। শিশুরা পিতা-মাতাকে হারিয়ে এতিমখানা/ শিশুসদনে কিংবা আত্মীয়স্বজনের কাছে আশ্রয় নেয়। প্রবীণরা সন্তান ও সহায়-সম্বলহীন হয়ে দয়া করুণার পাত্র হিসেবে টিকে থাকার লড়াইয়ে শামিল হন।

যুদ্ধ মানেই বড় ধরনের পরিবর্তন। দালানকোঠা, বাড়িঘর, পথঘাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, সম্পর্ক সবকিছু ধ্বংস করে দিয়ে যায়। রাষ্ট্রের চেহারা পরিবর্তন হয়ে যায়। শাসকশ্রেণির পালাবদল শুরু হয়। খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়।

অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনে দুর্ভোগ তৈরি করে। যুদ্ধকে কেন্দ্র করে একশ্রেণির মানুষের হাতে প্রচুর অর্থসম্পদ জমা হয়। প্রবীণদের পক্ষে নতুন এই পরিস্থিতি মানিয়ে নেয়া অনেক কষ্টের। বেশির ভাগ প্রবীণের হাতে তেমন টাকা-পয়সা থাকে না। পরিবারের নিকটতম সদস্যরা জীবন-জীবিকার জন্য দূর দেশে চলে যায়। আর যারা প্রবীণদের সঙ্গে থাকেন তারাও অর্থনৈতিক দুর্দশায় দিশেহারা। এরকম পরিস্থিতিতে প্রবীণরা আশ্রয়, খাবার, চিকিৎসার সংকটে পড়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়।

যুদ্ধ যখন ভয়াবহ রূপ নেয়, তখন দুর্বল প্রবীণরা গোলার আঘাতে প্রাণ হারায় নিরাপদ স্থানে যেতে না পারার কারণে। শরণার্থী হিসেবে মাইলের পর মাইল হেঁটে, খাল-বিল, নদ-নদী, সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিয়ে দুর্গম পথে ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহনে অতিক্রম করা প্রবীণদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। যুদ্ধ প্রবীণ জীবনকে দুর্বিষহ, বেদনাদায়ক ও শোকাতুর করে তোলে। অনেক সময় স্বজন হারানোর শোকে কাতর হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। অজানা আশঙ্কায় নিদ্রাহীন জীবনযাপন প্রবীণকে কাহিল করে তোলে।

সাম্প্রতিককালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সারা দুনিয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। তেল-গ্যাস-কয়লা সরবরাহ ঝুঁকিতে পড়েছে। মুদ্রাস্ফীতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে চলছে। ডলার-সংকটে আমদানিবাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। পণ্যবাহী জাহাজের ভাড়া অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির ফলে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়াতে হচ্ছে। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছাড়া অন্যকিছু ক্রয়ের ক্ষেত্রে অতি সতর্কতার নীতি গ্রহণ করেছে। অর্থনৈতিক কর্মকা- স্থবির হয়ে পড়লে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। এমন পরিস্থিতিতে প্রবীণরা অনেক বেশি আর্থিকসংকটে পড়বেন। বেশির ভাগ প্রবীণের কাছে নগদ অর্থ থাকে না। থাকে জমিজমা, দালানকোঠা, ঘরবাড়ি যা ইচ্ছে করলে বিক্রি করা যায় না। আর যদি বিক্রি করা হয়, তাতে বাজারমূল্য পাওয়া যায় না।

গত কয়েক শতাব্দী ধরে প্লেগ, গুটি বসন্ত, যক্ষ্মা, কলেরা, ম্যালেরিয়াসহ নানারকমের সংক্রামক ব্যাধি কোটি কোটি মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছে। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক মানুষ ও শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। কোনো একটি এলাকায় মহামারি ছড়িয়ে পড়লে শিশু এবং প্রবীণরা সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকে। মহামারিতে কোটি কোটি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। কোনো কোনো এলাকা জনশূন্য হয়ে যেত। মৃত্যু ভয়ে মানুষ গ্রাম শহর থেকে পালিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে গেছে। খাবার এবং চিকিৎসার অভাবে পথে ঘাটে মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পৃথিবীর মানুষের কাছে এই প্রথম কোভিড-১৯ অতিমারি হিসেবে আবির্ভাব হয়েছে। পৃথিবী জুড়ে ভয়ংকর রকমের মৃত্যু আতঙ্ক মানুষকে দিশেহারা করে তুলেছিল। উন্নত দেশের প্রবীণ নিবাসগুলোতে চিকিৎসাসেবার অভাবে প্রবীণরা বেঘোরে মারা যান। অতীতে মহামারিতে এর থেকে অনেক বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। তবে সেটা হয়েছে আঞ্চলিকভিত্তিতে। এবারই প্রথম পৃথিবীর প্রায় সব দেশে একযোগে কোভিড-১৯ আক্রমণ করে জনজীবন পর্যুদস্ত করে দেয়। এই রোগে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুবরণ করেন প্রবীণরা। হাসপাতালে বেশি গেছেন প্রবীণেরা। অক্সিজেনসহ জীবন রক্ষাকারী ওষুধ দরকার হয়েছে প্রবীণদের। প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের বসতবাটি, গৃহপালিত পশুপাখি, বনজঙ্গল, গাছপালা, ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, নদীভাঙনে ফসল উৎপাদনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। অঞ্চলভেদে খাবার ও পানীয় জলের সংকট তীব্র হয়ে ওঠে। প্রবীণরা শারীরিক ও মানসিকভাবে কিছুটা দুর্বল থাকায় খাবার ও পানীয় জল সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে যায়। যারা আর্থিকভাবে বেশি দুর্বল তারা খাবার জোগাড় করতে পারে না। মানুষের কাছে চেয়ে চিন্তে ক্ষুধা নিবারণ করে কিংবা খাবারের অভাবে মৃত্যুবরণ করে।

নদীভাঙনের ফলে নদীগর্ভে বিলীন হওয়া অধিকাংশ জমির মালিক প্রবীণরা। তাদের ক্রয়কৃত কিংবা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমি চোখের সামনে নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার দৃশ্য অনেক বেশি পীড়াদায়ক। সর্বস্ব হারানো প্রবীণরা আশ্রয়ের সন্ধানে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। পরিচিত স্থান, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, চেনা-জানা মানুষদের রেখে অন্যত্র চলে যাওয়া অনেক বেশি কষ্টের। বন্যার পানিতে হাওর-বাঁওড় ডুবে গিয়ে ফসলি জমির ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই ক্ষয়ক্ষতির একটা অংশ প্রবীণদের বহন করতে হয়। ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস সর্বোচ্চ বিপৎসীমার সংকেতের মধ্যে থাকলেও প্রবীণদের নিরাপদ আশ্রয়ে আনা কঠিন হয়ে যায়। চলাচলে অক্ষম ব্যক্তিকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসার জন্য তিন/চার জনের প্রয়োজন হয়। দুর্যোগের মুহূর্তে তিন/চার জন উদ্ধারকর্মী পাওয়া অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। যদিও বা আত্মীয়স্বজন, উদ্ধারকর্মীরা প্রবীণকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসতে চায়, তখন কেউ কেউ নিজের বাড়িঘর, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, আসবাবপত্র রেখে আসতে চান না। শেষ পর্যন্ত যেসব প্রবীণরা আশ্রয় কেন্দ্রে আসেন তারা পায়খানা প্রস্রাবের সমস্যায় পড়েন। টয়লেট নোংরা, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, সীমিতসংখ্যক টয়লেট থাকায় প্রবীণদের মধ্যে টয়লেট ব্যবহার করতে বিরক্ত হয়ে ওঠেন। কেউ কেউ পায়খানা-প্রস্রাব আটকে রাখতে পারেন না, তারা থাকার জায়গা এবং টয়লেট অপরিষ্কার করে দিতে পারেন। এতে করে আশ্রয় কেন্দ্রে আসা অন্যরা বিরক্তি প্রকাশ করেন। নোংরা পরিবেশ থেকে ডায়ারিয়া আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

অর্থাৎ সব দুর্যোগ-দুর্বিপাকে প্রবীণরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে এবং কষ্ট পায়। আমাদের মনে রাখতে হবে প্রবীণরা কারো দয়া বা করুণার পাত্র নন। তাদের পরিশ্রম করে গড়ে তোলা বর্তমানে আমাদের বসবাস। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে প্রবীণদের বিশেষ বিবেচনায় সর্বোচ্চ সেবা-যত্ন নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : প্রবীণ বিষয়ে লেখক, গবেষক ও সংগঠক

COMMENTS

ফেসবুকে ফলো করুন...


Developed by Julius Choudhury
নাম

অপরাধ,88,অর্থনীতি,151,আইন ও আদালত,39,আন্তর্জাতিক,94,আবহাওয়া,28,আশুলিয়া,1,এভিয়েশন,3,কক্সবাজার,6,কলকাতা,2,কিশোরগঞ্জ,18,কুড়িগ্রাম,15,কুমিল্লা,5,কুষ্টিয়া,8,কূটনীতি,3,কৃষি,15,ক্যাম্পাস,15,খাগড়াছড়ি,1,খুলনা,1,খেলা,78,গণমাধ্যম,181,গাইবান্ধা,2,গাজীপুর,208,গোপালগঞ্জ,5,চট্টগ্রাম,16,চাঁদপুর,1,চাকরি,5,জয়পুরহাট,2,জাতীয়,111,জাপান,1,জামালপুর,5,টাঙ্গাইল,7,ঠাকুরগাঁও,1,ঢাকা,1,ঢাবি,2,তুরস্ক,1,দিনাজপুর,17,ধর্ম,18,নড়াইল,3,নবাবগঞ্জ,1,নরসিংদী,12,নাটোর,2,নির্বাচন,4,নীলফামারী,1,নেত্রকোণা,8,নেপাল,3,নোয়াখালী,2,পরিবেশ,11,পাকিস্তান,2,পাবনা,130,প্রবাস,5,প্রযুক্তি,53,ফটো,1,ফিলিপাইন,1,ফেনী,3,বগুড়া,1,বরিশাল,3,বাং,1,বাংলাদেশ,2,বাগেরহাট,2,বান্দরবান,9,বিচিত্র,2,বিনোদন,23,বিশেষ প্রতিবেদন,16,বিশ্ব,296,বেনাপোল,1,ব্যাংক,2,ব্রাহ্মণবাড়িয়া,12,ভারত,10,ভুটান,1,ভ্রমণ,9,মতামত,14,ময়মনসিংহ,13,মানিকগঞ্জ,1,মালয়েশিয়া,1,মিয়ানমার,1,মুন্সীগঞ্জ,2,মেহেরপুর,13,যশোর,1,যুক্তরাষ্ট্র,2,যোগাযোগ,3,রংপুর,273,রাঙ্গামাটি,1,রাজধানী,70,রাজনীতি,224,রাজশাহী,2,রাশিয়া,2,লক্ষ্মীপুর,3,লালমনিরহাট,4,শরীয়তপুর,2,শিক্ষা,112,শিল্প ও সংস্কৃতি,3,শেরপুর,1,সংস্কৃতি,7,সাতক্ষীরা,2,সাভার,3,সারাদেশ,628,সাহিত্য,10,সিলেট,6,সুনামগঞ্জ,1,স্বাস্থ্য,57,
ltr
item
NNB - News Network of Bangladesh: যুদ্ধ মহামারি দুর্যোগে প্রবীণরাই বেশি ভোগে
যুদ্ধ মহামারি দুর্যোগে প্রবীণরাই বেশি ভোগে
যুদ্ধ মহামারি দুর্যোগে প্রবীণরাই বেশি ভোগে
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhhsTOLbu8ZnMiE9FyzTZ79RVWxBT30dE4nxML09Bi21ruBmo0YcPNiGANMhk-lEySPCLxaDZRVRsOTjELIfLhAS2F9FGM5fyKpmMvSn7tFUt117f2kJmGK1m-bOSLabAhA1mSSIN9nrbMeC74afiMhJTZo4wfKOXm8rSc8oTkWC-0omt0b8eQQPL7g/s320/motamot.jpg
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhhsTOLbu8ZnMiE9FyzTZ79RVWxBT30dE4nxML09Bi21ruBmo0YcPNiGANMhk-lEySPCLxaDZRVRsOTjELIfLhAS2F9FGM5fyKpmMvSn7tFUt117f2kJmGK1m-bOSLabAhA1mSSIN9nrbMeC74afiMhJTZo4wfKOXm8rSc8oTkWC-0omt0b8eQQPL7g/s72-c/motamot.jpg
NNB - News Network of Bangladesh
https://edition.nnb.com.bd/2023/05/010523052805.html
https://edition.nnb.com.bd/
https://edition.nnb.com.bd/
https://edition.nnb.com.bd/2023/05/010523052805.html
true
8430089477468953663
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts সব দেখনু Read More Reply Cancel reply Delete By হোম PAGES POSTS সব দেখনু সম্পর্কিত বিষয় ARCHIVE খোঁজ ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy Table of Content