$type=ticker$c=12$cls=0$b=0

কেমন চাই ২০২৩-এর পৃথিবী

সুধীর সাহা 

২০২৩ চলছে। এ মুহূর্তে একটাই চাহিদা- বদলে যাক আমাদের দেশটাও; বদলে যাক বাংলাদেশ। বদলে যাক পুরো দুনিয়াই। চেনা হয়ে গেছে বিগত পৃথিবীটাকে। সেখানে অল্প কিছু সৌভাগ্যবান ছাড়া কার্যত কারো জীবনে নিশ্চয়তা বা নিরাপত্তা বলে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। আর্থিক অনিশ্চয়তা সেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, সমাজ, সংস্কৃতি, এমনকি পারিবারিক পরিসরের অনিশ্চয়তাকেও বাদ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। সেই অনিশ্চয়তার পথ ধরেই বৃদ্ধি পেয়েছে বিচ্ছিন্নতার। দুনিয়াজুড়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রকৃত সংযোগ ক্রমেই কমছে। মনের পরিধি যতই ছোট হচ্ছে, আমাদের পারস্পরিক যোগাযোগ ততই কমছে, ততই তা বাজারের লেনদেনে রূপ নিচ্ছে। এ বাজার পুঁজির নির্দেশে চলে। এমনকি একান্ত পারিবারিক সম্পর্কের পরিসরেও আক্ষরিক অর্থে অহরহ বাজার ঢুকে পড়ছে। সম্পর্কগুলোকে সেই বাজার ব্যবস্থাই নিয়ন্ত্রণ করছে। সেখানে আর যাই থাক, মনের আকুলতা-ব্যাকুলতা নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন একটাই- আমরা কি এটাই চাই?

এককথায় উত্তর নাই বা দিলাম। একটু ঘুরে আসি না অতীতের পথে। ১০১ বছর আগের একটি তারিখ- ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস মাথা তুলে উঠল। মতের অমিলও তখন থেকেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। কেউ বিশ্বাসী কট্টরপন্থায়, কেউ আবেদন-নিবেদনে। কারো দাবি পূর্ণ স্বরাজ, কেউ আবার চায় ইংরেজদের সঙ্গে সহাবস্থান- মিলেমিশে সরকার চালাতে। কিন্তু তারপরও দিনের শেষে সব মত মিলত একটা স্টেশনে- বিভাজন থেকে মুক্তির। ভারতবর্ষের ঐক্যে কিছুতেই ফাটল ধরানো যাবে না। তারপর দিন গেছে অনেক। পথ ধরে রাখতে পারেনি ফাটলের জোড়া। সৃষ্টি হয়েছে পাকিস্তান আর ভারতের। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ সেই মনের ব্যাকুলতার হাতছানিকে কিছুতেই ভুলে থাকতে পারেনি। সুযোগ ও লগ্নের অপেক্ষা ছিল মাত্র। সেই সুযোগটাই কাজে লেগে গেল। বাঙালি হাতে হাত মিলাল; ডাক এলো অভিন্নতা ও সম্প্রীতির। বজ্রখ-ের সেই ডাক উপেক্ষা করতে পারল না সেদিনের পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা। যোগ্য হাতে, যোগ্য কণ্ঠে শোভা পেল- ধ্বনিত হলো সম্প্রীতির মালা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালির সুপ্ত অখ-তার চিন্তাকে শানিত করে দিলেন। বাঙালির হৃদয়ে ভালোবাসার বীজ বপন করে দিলেন। তিনি বাঙালিকে স্বপ্ন দেখালেন এমন একটি দেশের- যেখানে মানুষ হবে অভিন্ন, মানুষ ভালোবাসবে মানুষকে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে। ধারাবাহিকভাবে ছড়ানো ঘৃণার বিরুদ্ধে নতুন ডাক এলো- সম্প্রীতির ডাক, ঐক্যের ডাক। ১৯৭১-এর বাংলাদেশ প্রমাণ করে দিল, বাংলাদেশের মানুষ ভালোবাসার মন নিয়েই বাঁচতে চায়। দুঃশাসনের কারবারিরা তাদের কানে যতই বিষ ঢালুক, যতই মনোভূমিতে বপন করুক ঘৃণার বীজ- ১৯৭১-এর বাংলাদেশ প্রমাণ করে দিল, তা শাশ্বত নয়, চিরস্থায়ী নয়। সবশেষে তারা শত বিদ্বেষ, শত হিংস্রতার পাথর ভেঙে মুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে কোনো ভুল করল না।

শাসক বদলেছে। সময়, সমাজ, রাজনীতি- এক জায়গাতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। বদলেছে সবকিছু। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর লড়াইটা বুঝি আজো সেই জায়গাতেই আটকে আছে। সেদিনের মতো আজো অপপ্রচার, প্রোপাগান্ডা আছে, ঘৃণা আর বিদ্বেষ আছে; আজো আছে এক নম্বর বিভাজন রেখাটি- ধর্মপরিচয়ে বিভাজন। বিভাজনের প্রথম ও প্রধান নিশানা- কোথাও সংখ্যালঘু মুসলমান, কোথাও সংখ্যালঘু হিন্দু। এসব দেশে কৌশলে সংখ্যালঘুর প্রতি সংখ্যাগুরু সমাজের বহু লোকের অন্তর থেকে সুনজর সরিয়ে দেয়া হচ্ছে সুচতুরতার সঙ্গে। আপাতদৃষ্টিতে সব ঠিকঠাক মনে হলেও ভেতরে ভেতরে ঘৃণা আর বিদ্বেষের বিষয় ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সমাজের প্রতি স্তরে। সংখ্যাগুরুদের অনেকের মনে প্রশ্ন থাকলেও দিনশেষে মেনে নিচ্ছে- সবই মানছি। কিন্তু ওদের বাড়াবাড়ি তো এরা বন্ধ করছে। আমাদের চারদিকে মানুষের আচরণ লক্ষ্য করে এটুকু বলাই যায় যে, এমনি এমনিই হোক, আর দুষ্টু লোকের কুমন্ত্রণার ফলেই হোক- আজকাল ঘরে-বাইরে বহু মানুষের চিন্তা ও আচার-আচরণে প্রায়ই যা ফুটে ওঠে, তাকে ভালোবাসার প্রকাশ বলা কঠিন। রাজনীতির যুদ্ধভূমিতে কিংবা টিভি চ্যানেলের সাজানো যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার আসরে তো বটেই, তথাকথিত সমাজমাধ্যমের ঘরে ঘরে যে তীব্র বিদ্বেষ আর তিক্ত অসহিষ্ণুতার মূর্তি দেখি, তাতে আতঙ্কিত না হয়ে উপায় দেখি না। অনেকেই হয়তো যুক্তি দেবেন। রাজনীতি, টেলিভিশন কিংবা সমাজমাধ্যম দেখে বৃহত্তর বাংলাদেশের কিংবা ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মন বিচার করলে ভুল হবে। বেশিরভাগ মানুষ আজো ভালোবাসার ভুবনেই বসবাস করেন। কথাটা হয়তো উড়িয়ে দেয়া যায় না। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এতটা উচ্ছন্নে গেলে দেশটা এখনো হয়তো চলতেই পারত না। ভালোবাসার বাঁধন পুরোপুরি হয়তো এখনো ছিন্ন হয়ে যায়নি। এখনো কিছু মানুষের হৃদয় কাঁদে অন্য মানুষের জন্য। কিন্তু যে বিপন্নতার গহ্বরে আমরা ক্রমেই প্রবেশ করছি, এসব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের নিশ্চুপ ভালোবাসা আমাদের হয়তো সেখানে থেকে বাঁচাতে পারবে না। ভালো মানুষগুলোকে সোচ্চার হতে হবে। বিস্তীর্ণ অন্ধকার ঠেলে ঘৃণা আর বিদ্বেষের বিরুদ্ধে কঠিন লড়াই করতে হবে। সুস্পষ্টভাবে বাস্তবতাকে স্বীকার করে সেখান থেকেই প্রতিকারের রাস্তায় হাঁটতে হবে। সে কাজটা মোটেও সহজ হবে না। দীর্ঘদিন ধরে কুমন্ত্রণা দিয়ে অনেক মানুষের মনে যে বিষ ঢোকানো হয়েছে, তার ভুল বিশ্বাসকে সুমন্ত্রণা দিয়েই নিষ্কাশন করতে হবে ধীরে ধীরে। অনেকে মিলে ঠিক কথাগুলো আরো অনেককে বলতে হবে, বিদ্বেষের বিপরীতে সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।

প্রতিহিংসা-প্রতিশোধ-বদলার জয়জয়কার আজকের সমাজের সর্বত্র। এটা নতুন কোনো কনসেপ্ট নয়। আবহমানকাল ধরেই সংস্কৃতির নানা মাধ্যমে প্রতিহিংসা একটি জনপ্রিয় থিম। বিশেষ করে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রতিহিংসা। সেই থিমকে একদল স্বার্থান্বেষী মহল পুঁজি করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে তা সক্রিয় করে দিয়েছে। সবাইকে বোঝানো হয়েছে- তোমার ওপর যে অন্যায় হয়েছে, সেই অন্যায় ফিরিয়ে দিতে হবে। যারা তোমার ওপর অন্যায় করেছে, তাদের উচিত শিক্ষা দিতে হবে। ‘চোখের বদলে চোখ’- এ সেøাগান নিয়ে মাঠে নেমেছে দুষ্ট লোকদের বড় একটি দল। ক্রমেই তাদের দলে নতুন নতুন মুখ এসেছে। গত কয়েক দশক ধরেই চলছে এ সর্বনাশা খেলা। রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মাঠে তাই সর্বত্রই আজ প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধের দল ভারী। পৃথিবীর বর্তমান অবস্থানও এই প্রতিহিংসার অনুকূলে। আমেরিকার রিপাবলিকান দল, ব্রিটেনের ব্রেক্সিটের সমর্থকগোষ্ঠী, ফ্রান্সের অতি দক্ষিণপন্থি ম্যারিন ল্য পেনের দল, জার্মানির নব্য-নাৎসি প্রভাবিত এএফডি, ইতালি-হাঙ্গেরি-পোল্যান্ডের বর্তমান উগ্র শাসকচক্র, সুইডেন সরকারের ক্ষমতার সঙ্গী নব্য-নাৎসি দল, তুরস্কের এরদোয়ান সরকার, ভারতের বিজেপি সরকার- প্রত্যেকেই আজ বিভাজন নিয়ে তাদের রাজনীতি করতে উদ্যত। এদের প্রতি আছে নিজ নিজ দেশের মানুষের সমর্থনও। দুনিয়াজুড়ে আর্থিক অসাম্য যতই বাড়ছে, তার প্রতিক্রিয়ায় উগ্র দক্ষিণপন্থিদের প্রতি ততই মানুষের সমর্থন বাড়ছে। দুনিয়াজুড়ে বামপন্থি শ্রমিক সংগঠনের জোর কমছে। এ পরিস্থিতিতে সমানতালে এগিয়ে গিয়েছে মানুষের সাংস্কৃতিক অনিশ্চয়তা। আর এ অনিশ্চয়তাকে কাজে লাগাচ্ছে দক্ষিণপন্থি রাজনীতি। তারা সুকৌশলে হাজার বছরের পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে নতুন বিদ্বেষ তৈরি করছে এবং সনাতন সমাজে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

২০২৩-এর সামাজিক, রাজনৈতিক আর ধর্মীয় হানাহানির এ আবহাওয়ায় আমাদের দৃঢ়পথের সন্ধানে সবাইকে একত্রিত করার কাজটি করতে হবে। ২০২৩ সাল আমাদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ বছরই আমাদের দৃঢ়ভাবে চাইতে হবে তেমন একটি পৃথিবী- যেখানে রাজনৈতিক, সামাজিক আর ধর্মীয় হানাহানি এবং দাঙ্গার আর্তনাদ বাতাসকে ভারাক্রান্ত করবে না।


সুধীর সাহা : কলাম লেখক।

ceo@ilcb.net


COMMENTS

ফেসবুকে ফলো করুন...


Developed by Julius Choudhury
নাম

অপরাধ,81,অর্থনীতি,130,আইন ও আদালত,25,আন্তর্জাতিক,53,আবহাওয়া,25,আশুলিয়া,1,এভিয়েশন,3,কক্সবাজার,5,কলকাতা,2,কিশোরগঞ্জ,17,কুড়িগ্রাম,15,কুমিল্লা,5,কুষ্টিয়া,8,কূটনীতি,3,কৃষি,14,ক্যাম্পাস,15,খাগড়াছড়ি,1,খুলনা,1,খেলা,74,গণমাধ্যম,179,গাইবান্ধা,2,গাজীপুর,192,গোপালগঞ্জ,5,চট্টগ্রাম,15,চাঁদপুর,1,চাকরি,5,জয়পুরহাট,2,জাতীয়,3,জাপান,1,জামালপুর,5,টাঙ্গাইল,7,ঠাকুরগাঁও,1,ঢাকা,1,ঢাবি,1,দিনাজপুর,17,ধর্ম,17,নড়াইল,3,নবাবগঞ্জ,1,নরসিংদী,12,নাটোর,2,নীলফামারী,1,নেত্রকোণা,8,নেপাল,1,নোয়াখালী,2,পরিবেশ,11,পাকিস্তান,2,পাবনা,129,প্রবাস,4,প্রযুক্তি,51,ফটো,1,ফিলিপাইন,1,ফেনী,3,বগুড়া,1,বরিশাল,3,বাং,1,বাগেরহাট,2,বান্দরবান,9,বিচিত্র,2,বিনোদন,22,বিশেষ প্রতিবেদন,16,বিশ্ব,263,বেনাপোল,1,ব্যাংক,1,ব্রাহ্মণবাড়িয়া,12,ভারত,5,ভুটান,1,ভ্রমণ,9,মতামত,14,ময়মনসিংহ,13,মানিকগঞ্জ,1,মিয়ানমার,1,মুন্সীগঞ্জ,1,মেহেরপুর,13,যশোর,1,যুক্তরাষ্ট্র,2,যোগাযোগ,3,রংপুর,273,রাঙ্গামাটি,1,রাজধানী,69,রাজনীতি,189,রাজশাহী,2,রাশিয়া,2,লক্ষ্মীপুর,3,লালমনিরহাট,4,শরীয়তপুর,2,শিক্ষা,97,শিল্প ও সংস্কৃতি,2,শেরপুর,1,সংস্কৃতি,7,সাতক্ষীরা,2,সাভার,3,সারাদেশ,592,সাহিত্য,7,সিলেট,6,সুনামগঞ্জ,1,স্বাস্থ্য,56,
ltr
item
NNB - News Network of Bangladesh: কেমন চাই ২০২৩-এর পৃথিবী
কেমন চাই ২০২৩-এর পৃথিবী
কেমন চাই ২০২৩-এর পৃথিবী
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEixqy0HvkOvZkolNVRz1Vmxwqejk6ZOB-dDmftOyAbf8x3S2jEjEPKjDY81o5FUxdg61Y09r1lJYwN2gDu9HmKRL5l-zks8F_jbDMWfpljJhUFHzaLEwOvcsd4H0Ju0uLATcfOaGz66YlrGoShdU8dKdDiPqVW_qRGW4tXLUOuvCFZQh0Jsw84_sgTO/s320/pic.jpg
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEixqy0HvkOvZkolNVRz1Vmxwqejk6ZOB-dDmftOyAbf8x3S2jEjEPKjDY81o5FUxdg61Y09r1lJYwN2gDu9HmKRL5l-zks8F_jbDMWfpljJhUFHzaLEwOvcsd4H0Ju0uLATcfOaGz66YlrGoShdU8dKdDiPqVW_qRGW4tXLUOuvCFZQh0Jsw84_sgTO/s72-c/pic.jpg
NNB - News Network of Bangladesh
https://edition.nnb.com.bd/2023/01/010523012901.html
https://edition.nnb.com.bd/
https://edition.nnb.com.bd/
https://edition.nnb.com.bd/2023/01/010523012901.html
true
8430089477468953663
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts সব দেখনু Read More Reply Cancel reply Delete By হোম PAGES POSTS সব দেখনু সম্পর্কিত বিষয় ARCHIVE খোঁজ ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy Table of Content