এনএনবি নিউজ
গাইবান্ধা-১ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যাকাণ্ডের মূল পরিল্পনাকারী ছিলেন একই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল কাদের খান। রাজনৈতিক বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার ও পুনরায় সংসদ সদস্য হওয়ার লোভে লিটনকে হত্যার পরিকল্পনা সাজান তিনি।
হত্যাকা-ের নীলনকশা সম্পর্কে বছর খানেক আগেই চন্দন কুমার রায়ের সঙ্গে আলোচনা করেন আব্দুল কাদের খান। লিটন হত্যার সার্বিক কাজের সমন্বয় করেন চন্দন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর চন্দন ও আবদুল কাদের খান তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মাধ্যমে সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে তাঁর নিজ বাড়িতে গুলি করে হত্যা করেন। এ ঘটনায় নিহতের ছোট বোনের দায়ের করা হত্যা মামলায় আবদুল কাদের খানসহ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ৭ সহযোগীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে ঘটনার পর থেকে চন্দন আত্মগোপনে চলে যান। হত্যাকাণ্ডের ১৫ দিন পর চন্দন তার আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চলে যান।
লিটন হত্যা মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষে তদন্তকারী কর্মকর্তা ২০১৭ সালের ৩০ এপ্রিল মূল পরিকল্পনাকারী আবদুল কাদের খানসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। ৮ আসামির মধ্যে হত্যাকাণ্ডের প্রধান সমন্বয়কারী চন্দন কুমার রায় পলাতক ছিলেন। ২০১৯ সালের ২৮ নভেম্বর বিচার কার্যক্রম শেষে গ্রেফতার ৬ জন এবং পলাতক আসামি চন্দনসহ মোট ৭ আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। মামলার এক আসামি সুবল চন্দ্র কারাগারে বিচারাধীন থাকাকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। পলাতক চন্দন কুমার রায়কে গ্রেফতারে ইন্টারপোল কর্তৃক রেড নোটিশ জারি করা হয়।
সম্প্রতি গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, পলাতক চন্দন দেশে অবস্থান করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় রোববার (১১ সেপ্টেম্বর) দিনগত রাতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, র্যাব-৩ ও র্যাব-৬ এর যৌথ অভিযানে সাতক্ষীরার ভোমরা এলাকা থেকে পলাতক চন্দন কুমার রায়কে (৪৩) গ্রেফতার করা হয়।
সোমবার (১২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ও গ্রেফতার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ সংসদীয় আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল কাদের খানের পরিকল্পনাতে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। আবদুল কাদের খান ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুন্দরগঞ্জ এলাকায় নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। সংসদ সদস্য থাকাকালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার দুর্নীতির বিষয়ে মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন অভিযোগ উথাপন করেন। পরে ২০১৪ সালে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাইবান্ধা-১ আসন থেকে মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আগের চাপা ক্ষোভ, রাজনৈতিক বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার ও পুনরায় সংসদ সদস্য হওয়ার লোভেই লিটনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন আবদুল কাদের খান।
র্যাবের কমান্ডার আরও বলেন, গ্রেফতার চন্দন কুমার রায় সুন্দরগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহ-দপ্তর সম্পাদক ছিলেন। ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময় সংসদ সদস্য লিটনের সমর্থিত লোকজনের সঙ্গে তার মারামারির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় চন্দন গুরুতর আহত হয়েছিলেন।
গ্রেফতার হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে চন্দন জানান, সংসদ সদস্য লিটনের প্ররোচনায় চন্দনকে একটি মামলার আসামি বানিয়ে তাকে গ্রেফতার করানো হয়। ওই মামলায় চন্দন ১৯ দিন কারাভোগ করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে থাকা চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতনসহ অন্যান্য মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য তিনি এমপি লিটনের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। কিন্তু এমপি লিটন তাকে আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে বলেন। এতে এমপি লিটনের প্রতি চন্দনের ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে দুর্নীতি, চাঁদাবাজির অভিযোগে ২০১৬ সালে চন্দনকে দলীয় পদ থেকে বহিষ্কার করে সংসদ সদস্য লিটন।
এরপর সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল কাদের খানের পিএস শামসুজ্জোহার সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে আবদুল কাদের খানের সঙ্গে চন্দনের সখ্য তৈরি হয়। এদিকে চন্দনের ভগ্নিপতি সুবল রায় এমপি লিটনের বাড়ির দারোয়ান হিসেবে কাজ করতেন। সেই সুবাদে লিটনের চলাফেরার বিষয়ে তথ্য জানা সহজ ছিল চন্দনের। এমপি লিটনকে হত্যাকাণ্ডের কয়েকটি পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ায় আবদুল কাদের খান চন্দনের সহযোগিতা চান। নতুন পরিকল্পনার মাধ্যমে লিটনকে হত্যা করা সম্ভব হয় তাদের।
র্যাব কর্মকর্তা আরও বলেন, এমপি লিটন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চন্দন ছিলেন প্রধান সমন্বয়কারী। তিনি লিটনের গতিবিধি ও অবস্থান সম্পর্কে আবদুল কাদের খান ও তার সহযোগীদের তথ্য দিতেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, হত্যাকাণ্ডে তাদের সহযোগী মেহেদী, শাহীন, রানা, শামসুজ্জোহা ও ড্রাইভার হান্নান অস্ত্র চালানো ও হত্যাকাণ্ডের পর দ্রুত পালানোর প্রশিক্ষণ নেন। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে এমপি লিটনের ঢাকা থেকে গাইবান্ধা যাওয়ার তথ্য দেন চন্দন। মাঝপথে হত্যার পরিকল্পনা নিলেও কারণ বশত এমপি লিটন গাবতলী এসে ফিরে যাওয়ায় ওই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। পরে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে তারা এমপি লিটনকে তার নিজ বাড়িতেই হত্যার পরিকল্পনা করেন। সেই মোতাবেক ঘটনার দিন চন্দন ও তার চাচাতো ভাই সুবল লিটনের বাড়িতে অবস্থান করেন। এমপি লিটন কখন কী অবস্থায় থাকেন সেই সংক্রান্ত খোঁজখবর অন্যান্যদের দিতে থাকেন। ওই দিন বিকেলে এমপি লিটন তার নিজ বাড়িতে একা অবস্থান করছেন, এমন তথ্য হত্যাকারীদের জানান চন্দন। পরিকল্পনা মোতাবেক হত্যাকারী শাহীন, রানা ও মেহেদী মোটরসাইকেলযোগে এমপি লিটনের বাড়িতে যান এবং নৃশংসভাবে গুলি করে কিলিং মিশন সম্পন্ন করেন।
কে এই চন্দন কুমার রায়?
গ্রেফতার আসামি চন্দন কুমার রায় ২০১০ সালে ঢাকায় আসেন। রাজধানীর একটি অনলাইন পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন তিনি। দুই বছর সাংবাদিকতা করে পুনরায় গাইবান্ধা ফিরে যান এবং সেখানে স্থানীয় রাজনীতিতে যোগ দেন। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানায় তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতনসহ বেশ কয়েকটি মামলা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। গাইবান্ধার স্থানীয় সংসদ সদস্য লিটন হত্যাকাণ্ডের পর চন্দন ভারতে পালিয়ে যান। ভারতে তার কাছের আত্মীয়ের মাধ্যমে ‘শাওন রায়’ নামে ভুয়া নাগরিকত্ব, আধার/রেশন কার্ড তৈরি করে এবং ভারতেই অবস্থান করতে থাকেন। ভারত থেকে তিনি রংপুর ও গাইবান্ধা সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে গাঁজা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদকের চালান বাংলাদেশে পাঠাতে শুরু করেন। সম্প্রতি মাদক চোরাচালান সংক্রান্ত কাজে তিনি কিছুদিন ধরেই সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী এলাকা ভোমরায় অবস্থান করছিলেন। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে ভোমরা এলাকা থেকে চন্দন কুমার রায়কে গ্রেফতার করে র্যাব।
মাদকের অর্থ সংগ্রহ, মাদক কারবার তদারকি এবং মাদক কারবারিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার জন্য চন্দন বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে এর আগেও বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। গ্রেফতারকৃত চন্দনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানান র্যাব কর্মকর্তা।
COMMENTS