![]() |
ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনরত একদল বুয়েট শিক্ষার্থী। ছবি: সংগৃহীত |
সাবা বিনতে মুরতাজ
এনএনবি, ঢাকা
বুয়েটের শেরে বাংলা হলের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার পর বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হয়।
এর পরও বুধবার দিবাগত মধ্যরাতে (২৮ মার্চ, ২০২৪) ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেনসহ
শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতিতে নেতা-কর্মীদের একটি বহর বুয়েট ক্যাম্পাসের ভেতরে প্রবেশ
করে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালায়। বহিরাগত ছাত্রলীগ নেতা–কর্মীর ক্যাম্পাসে
অনুপ্রবেশের ঘটনায় উত্তাল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)
ক্যাম্পাস।
শিক্ষার্থীদের রাত ১০:৩০ টার পরে বুয়েট ক্যাম্পাসে থাকা নিষেধ এবং যেকোনো
প্রয়োজনে এর থেকে বেশি সময় ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে হলে ছাত্রকল্যাণ অধিদপ্তর
(ডিএসডাব্লিও) পরিচালকের অনুমতির প্রয়োজন পড়ে। সেক্ষত্রে ক্যাম্পাসে বহিরাগত
অনুপ্রবেশের ঘটনায় ডিএসডাব্লিও পরিচালক ও ছাত্রলীগপন্থী বুয়েটের শিক্ষার্থীদের
সংশ্লিষ্টতা আছে বলে মনে করছেন ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
বুয়েট ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীদের জন্য় নিরাপদ রাখতে ডিএসডাব্লিও পরিচালকের পদত্যাগ
ও জড়িত শিক্ষার্থীদের স্থায়ী বহিষ্কারের দাবিসহ ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির
বিরুদ্ধে ছয় দফা দাবিতে বিভিন্ন প্লাকার্ড হাতে নিয়ে বিক্ষোভ চলমান রেখেছেন
বুয়েটের শিক্ষার্থীরা।
বুয়েট শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও পাঁচ দফা দাবি
শুক্রবার (২৯ মার্চ, ২০২৪) দুপুরে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশের প্রতিবাদে বুয়েটের
শহিদ মিনার চত্বরে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে নানা
স্লোগান–সংবলিত পোস্টার নিয়ে একত্রিত হন। এসময় ৩০ ও ৩১ মার্চের টার্ম ফাইনাল
পরীক্ষাসহ সব একাডেমিক কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। এরপর সেখান
থেকে মিছিল নিয়ে তাঁরা প্রশাসনিক ভবনের দিকে গিয়ে ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের
পরিচালকের (ডিএসডব্লিউ) কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন।
এসময় এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বুয়েট শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে পাঁচ দফা
দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে– মধ্যরাতে রাজনৈতিক সমাগমের মূল সংগঠক
পুরকৌশল বিভাগের ২১তম ব্যাচের ছাত্র ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইমতিয়াজ
হোসেন বুয়েট থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার, হলের সিট বাতিলসহ ইমতিয়াজের সহযোগীদেরও
বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার।
শিক্ষার্থীদের দাবি ও আন্দোলনের মুখে শুক্রবার রাতেই
ইমতিয়াজ হোসেনের আবাসিক হলের আসন বাতিল করে বুয়েট প্রশাসন।
পরিবর্তিত ছয় দফা দাবি
শনিবার (৩০ মার্চ, ২০২৪) সকাল থেকে বিভিন্ন প্লাকার্ড হাতে নিয়ে বিক্ষোভ করেন
বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। এ সময় শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি ঘটনার
সঙ্গে জড়িত ২১তম ব্যাচের ছাত্র ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্য ইমতিয়াজ রাহিম
রাব্বীসহ ৬ ছাত্রকে দুপুর ২টার মধ্যে স্থায়ী বহিষ্কারের আল্টিমেটাম দেওয়া হয়।
এসময় ঘটনাপ্রবাহ অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা ছয় দফার পরিবর্তিত দাবি পেশ করে।
দাবিগুলো হলো:
১. বুয়েটের নীতিমালা ভঙ্গের দায়ে দুপুর ২টার মধ্যে লিখিতভাবে ইমতিয়াজ রাব্বির
স্থায়ী অ্যাকাডেমিক বহিষ্কার নিশ্চিত করা।
২. একই ঘটনায় ইমতিয়াজ রাব্বির সাথে বুয়েটের বাকি জড়িত শিক্ষার্থীদের স্থায়ী
অ্যাকাডেমিক এবং হল বহিষ্কারের নিশ্চিত করা। জড়িত শিক্ষার্থীদের একাংশের পরিচয়
হলো- এ. এস. এম. আনাস ফেরদৌস (স্টুডেন্ট আইডি: 1818004), মোহাম্মদ হাসিন আরমান
নিহাল (স্টুডেন্ট আইডি: 2106101), অনিরুদ্ধ মজুমদার (স্টুডেন্ট আইডি: 2106079),
জাহিরুল ইসলাম ইমন (স্টুডেন্ট আইডি: 2112031) এবং সায়েম মাহমুদ সাজেদিন রিফাত
(স্টুডেন্ট আইডি: 2106126)।
৩. ক্যাম্পাসে অনুপ্রবেশকারী বহিরাগত রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে বুয়েট
প্রশাসনের পক্ষ থেকে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া, তাঁরা কেন-কীভাবে প্রবেশ করার
অনুমতি পেলো এ ব্যাপারে বুয়েট প্রশাসনের পক্ষ থেকে লিখিত নোটিশ।
৪. ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের (ডিএসডাব্লিও) পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানের
দ্রুততম সময়ের মধ্যে পদত্যাগ।
৫. ৩০ মার্চ এবং ৩১ মার্চের টার্ম ফাইনাল সহ সকল একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন।
৬. আন্দোলনরত বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোন রকম হয়রানিমূলক ব্যবস্থা
নেওয়া যাবে না এই মর্মে লিখিত প্রতিশ্রুতি।
দাবিগুলো আদায়ে আন্দোলনরত বুয়েট শিক্ষার্থীরা রবিবার (৩১ মার্চ, ২০২৪) সকাল সাতটা থেকে বুয়েট শহিদ মিনারে জড়ো হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। শনিবারের মতো এদিনও ‘টার্ম ফাইনাল’ পরীক্ষা বর্জন করবেন শিক্ষার্থীরা।
৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন: বুয়েট উপাচার্য
ঘটনা তদন্তে ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে ওইদিন দুপুরে গণমাধ্যমকে
জানিয়েছেন বুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার।
তিনি বলেন, ‘ঘটনা তদন্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ৮
এপ্রিলের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের
দাবিকে অযৌক্তিক বলছি না; তাদের দাবির সঙ্গে আমরা সহমত পোষণ করছি। তবে হুট করে
কিছু করা যায় না।’
পরীক্ষা বর্জনের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, ‘আমরা পরীক্ষা স্থগিত করিনি, শিক্ষার্থীরা
বর্জন করেছে। তাঁরা পরীক্ষা স্থগিতের আবেদনও করেনি। পরীক্ষা হয়েছে, কিন্তু তাঁরা
পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল। শিক্ষার্থীরা ফের পরীক্ষার জন্য আবেদন করলে একাডেমিক
কাউন্সিল বিবেচনা করতে পারে।’
ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালকের পদত্যাগের দাবির প্রসঙ্গে তদন্ত কমিটি খতিয়ে
দেখে নিয়ম মেনে ব্যবস্থা নেবে বলে জানান উপাচার্য।
বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতি থাকতে হবে: ছাত্রলীগ সভাপতি
এদিকে বুয়েট শিক্ষার্থীর হলে আসন বাতিলের সিদ্ধান্তকে একটি অন্যায্য সিদ্ধান্ত
মনে করছেন ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন । ঘটনাটি অসাংবিধানিক, মৌলিক অধিকার
পরিপন্থি এবং শিক্ষাবিরোধী কর্মকাণ্ড বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘বুয়েটের একজন শিক্ষার্থীর যেমন রাজনীতি না করার অধিকার রয়েছে, ঠিক
তেমনি একজন শিক্ষার্থীর রাজনীতি করারও অধিকার রয়েছে। অন্যায়ভাবে একজন শিক্ষার্থীও
যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সে ক্ষেত্রে আমরা ছাত্রসমাজকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনের মধ্য
দিয়ে ফয়সালা করব।’
ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার নামে বুয়েটে হিযবুত তাহরীর, ইসলামি ছাত্রশিবিরসহ বিভিন্ন উগ্র ও মৌলবাদী ছাত্রসংগঠন এখানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে বলে বিস্ফোরক মন্তব্যও করেন ছাত্রলীগ সভাপতি।
এদিকে বুয়েটে শিবির ও হিযবুত তাহরীর কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে বুয়েটের অপর একদল শিক্ষার্থী। শনিবার (৩০ মার্চ, ২০২৪) বুয়েটের শহিদ মিনার পাদদেশে সংবাদ সম্মেলন করে এ দাবি করেন তাঁরা।
এরপরিপ্রেক্ষিতে ‘মৌলবাদী গোষ্ঠীর কালোছায়া থেকে মুক্ত করে বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতির দাবিতে’ রবিবার
(৩১ মার্চ, ২০২৪) বেলা ১১টায় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করবে ছাত্রলীগ।
বুয়েটে জঙ্গিগোষ্ঠী তৎপর কি না, তদন্ত করা হবে: শিক্ষামন্ত্রী
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) কোনো জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী গোপনে কার্যক্রম
পরিচালনা করছে কি না, তা গভীরভাবে তদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী
মহিবুল হাসান চৌধুরী।
শনিবার (৩০ মার্চ, ২০২৪) দুপুরে রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে মহান
স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সেমিনার শেষে সাংবাদিকদের
প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন মন্ত্রী।
মন্ত্রী বলেন, ‘কিছুদিন আগেও অনেকে অভিযোগ করেছেন যে কিছু জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী
বুয়েটে গোপনে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা ছিল। সে
বিষয়টি আমরা আরও গভীরভাবে তদন্ত করব।’
তিনি বলেন, ‘জঙ্গিবাদ নিয়ে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটও কাজ করবে। এ বিষয়টি শুধু
বুয়েটে তা নয়, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য।’
এসময় বুয়েটে শিক্ষার পরিবেশ যাতে কোনোভাবেই বিঘ্নিত না হয় সেজন্য সব পক্ষের প্রতি
আহ্বান জানান শিক্ষামন্ত্রী।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালে বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার পর
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল
বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ক্যাম্পাসে। আবরার হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত সবাই ছিলেন
ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার নেতা-কর্মী। ২০২১ সালে এ ঘটনায় করা মামলার রায়ে ২০ জনকে
মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় বিজ্ঞ আদালত।
COMMENTS