
মোল্লা জালাল
বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে আগামী অর্থবছরের জন্য উৎপাদন ও কর্মসংস্থানমুখী বাজেট করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বরাবরেরমত ‘তেলা মাথায় তেল দেওয়ার’ সূক্ষ্ণ মারপ্যাঁচের বাজেট না করে আগামীদিনের কথা মাথায় রেখে এখন-ই সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। ‘পদ্মা সেতু’ গোটা দেশকে যেভাবে জাগিয়ে তুলেছে তা অভূতপূর্ব । জাতির এই উচ্ছ্বাসের মধ্যে যেমন শক্তি ও সাহস আছে তেমনি বিপরীতে ঝুঁকিও কম নেই। সেই ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে সামনে এগুতে হবে। তার নির্দেশনা থাকতে হবে বাজেটে।
বৈশ্বিক মন্দা
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবের কথা মাথায় রেখে প্রধানমন্ত্রী দেশের আর্থ-সামজিক সকল ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রতা সাধন করতে বলেছেন। তিনি বলছেন, অপরিকল্পিত ব্যয় বন্ধ করতে। শুধু তা-ই নয়,সরকারি কর্মচারিদের বিদেশ সফরের লাগাম টেনে ধরা, উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহনের আগে প্রকল্প এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশ খেয়াল করা, দেশের প্রতিইঞ্চি জমি আবাদের আওতায় আনা, কৃষিজমি রক্ষায় যত্রতত্র শিল্প স্থাপন করতে না দেওয়া, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে উৎসাহিত করাসহ আরো অনেক কথা।
জনকল্যাণে শুধু সরকার নয়, জনপ্রতিনিধিরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। কারণ, জনপ্রতিনিধিদের নিয়েই গণতান্ত্রিক সরকার হয়। বাজেট অধিবেশনে জনপ্রতিনিধিদের কাছে নিন্ম, নিন্মমধ্য ও মধ্যবিত্তের মানুষ সেটাই প্রত্যাশা করে। আগামী অর্থ বছরের বাজেট উৎপাদন ও কর্মসংস্থানবান্ধব সাধারণ মানুষের বাজেট হলে তার প্রতিফলন জাতীয় নির্বাচনেও দেখা যাবে
সব শেষে জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য রাত ১০ টার পর হাট, বাজার,দোকান পাট সব কিছু বন্ধ রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি আঁচ করতে পেরেছেন ইউক্রেন-রাশিয়ার এই সর্বগ্রাসী যুদ্ধের শেষ পরিণতি কি হতে পারে। এই যুদ্ধের গোলাগুলি কোন এক সময় হয়তো থেমে যাবে। কিন্তু এর রেস কাটবে না। কারণ যুদ্ধ শুধু রণাঙ্গনেই নয়, সর্বত্রই শুরু হয়েছে। একের পর এক নিষেধাজ্ঞা,আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে নয়া মেরুকরণসহ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এই যুদ্ধ বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটাবে। সেরকম পরিস্থিতি মোকাবেলা করে টিকে থাকার জন্যই প্রধানমন্ত্রীর সতর্কতা। কেননা দেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, স্বপ্ন থাকবে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন নেই। বরং যে যারমত হিসাব কষতে শুরু করেছে।
দোকান পাট বন্ধের ঘোষনা ৮ টার বদলে ১০টায় গেছে। ব্যবসায়ীরা আরো সাবসিডি চাচ্ছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে বহু নজির আছে, দুর্ভিক্ষ, মহামারি, যুদ্ধ-বিগ্রহের সময় একশ্রেণির লোক বেশুমার অর্থ-সম্পদের মালিক হয়ে যায়। হচ্ছেও তা-ই। আর্ন্তজাতিক লুটেরা চক্রের লুটের সম্পদ রক্ষার নিরাপদ রক্ষক ‘সুইস ব্যাংক’।
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের জমানো টাকার পরিমাণ ৮ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৮ লাখ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে গত এক বছরেই জমা হয়েছে ২ হাজার ৯৯২ কোটি ডলারের অধিক টাকা। এ হিসাব শুধু নগদে জমানো টাকার। এর বাইরে সোন-দানা, হীরা, মনি-মুক্তার হিসাব আলাদা। গত দুই বছর দেশ করোনায় আক্রান্ত। ব্যবসা-বানিজ্য জীবন-জীবিকা সব কিছু প্রায় অচল ছিল। তারপরও এত বিপুল পরিমাণ টাকা সুইস ব্যাংকে গেল কেমনে। কারা, কোথা থেকে কিভাবে এত টাকা পাচার করলো এ প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। মোটা দাগে এর জবাব হচ্ছে ব্যাংক ও বাজার লুট করে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়েছে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী চাইলে কি হবে। তাঁর চার পাশের অনেকেই কমবেশি বেনিফিসিয়ারি। তারাই সব কিছু করে।
প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
শেখ হাসিনা সংসদ নেতা, সরকারের প্রধান নির্বাহী, প্রধানমন্ত্রী। তাই দেশের সব কিছু তাঁকেই দেখতে হয়। নিজ দলের লোকদের সামলানো থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের সকল চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র সবই সামলানোর দায় যেন তাঁর একার। এটা কি করে সম্ভব। একজন মানুষ সারাক্ষণ সবাইকে কেমনে পাহারা দিয়ে রাখবেন। তিনি কত দিক সামলাবেন। বাজেটের খসড়া নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী করেননি। করেছেন মন্ত্রী আমলারা। তারাই ঠিক করেছেন কোথা থেকে টাকা পাবেন, কোথায় কিভাবে খরচ করবেন।
তারাই প্রধানমন্ত্রীকে দিশা দিয়েছেন, কি করলে আগামী নির্বাচনে নৌকা খাল-বিল, নদী-নালা সাগর-মহাসাগর পেরিয়ে দিয়ে হুরহুর করে মহাকাশে পৌঁছে যাবে। প্রধানমন্ত্রীকে বলা হয়েছে, করোনা’র ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে মানুষের জীবন-জীবিকাকে প্রাধান্য দিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার লক্ষ্যে এবারের বাজেট বানানো হয়েছে। দেশের উন্নয়নের জন্য, দেশবাসীর একটু সুখ-শান্তির জন্য নিরন্তর লড়াই করা একজন মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাভাবিকভাবেই এধরনের পরিকল্পনার কথা শুনলে কিছুটা হলেও হাঁফ ছেড়ে নিশ্বাস নিবেন। ভিতরে কি আছে সেটার বিশ্লেষণ পরে করা যাবে।
অর্থমন্ত্রীর নজর
অর্থমন্ত্রী আগে থেকেই বড় ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ী বলেই তিনি জানেন, কোথায় ব্যবসা আছে। বাজেটের ঘাটতি পূরণের পন্থা খোঁজতে তিনি ব্যাংক এবং ডাকঘরে রাখা সাধারণ মানুষের সঞ্চয়পত্রের সন্ধান পেয়েছেন। আরেকটি উৎস হয়তো তার নজর এড়িয়ে গেছেন। সেটা হচ্ছে ‘মাটির’ ব্যাংক। বাংলাদেশে মানুষের ঘরে ঘরে ‘মাটির ব্যাংক’ আছে। সেখানেও অনেকে টাকা পয়সা জমায়। অর্থমন্ত্রী সেখানেও নজর দিতে পারেন! সেখান থেকেও তিনি বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য হয়তো অনেক টাকা পাবেন। আগে গ্রামাঞ্চলে প্রচলন ছিল, প্রত্যেক বাড়িতে দাদি, নানি, মা-খালারা ঘরে ঘরে ‘মুষ্টির চাল’ রাখতো। এখন অবশ্য সেটা নেই বললেই চলে। থাকলে অর্থমন্ত্রী ‘মুষ্টির চাল’ থেকেও আয়কর সংগ্রহ করতে পারতেন!
ডাকঘর সঞ্চয়
দেশের নিন্ম আয়ের মানুষ বিভিন্ন ব্যাংক বা ডাকঘরে সঞ্চয়ের টাকা রাখে। পরবর্তীতে এতে যুক্ত হয় নিন্ম মধ্য ও মধ্যবিত্তের মানুষ। তারাও ব্যাংক এবং ডাকঘরে শেষ জীবনের সহায় মনে করে কিছু কিছু করে টাকা পয়সা জমিয়ে রাখতো। ব্যাংকগুলোতে আগে ডিপিএস করা করা হতো, এখন সে ব্যবস্থা নেই। এখন হয় এফডিআর। এই এফডিআরে আগে লাখে প্রায় হাজার টাকা করে মাসে মুনাফা পাওয়া যেতো। বহু নিন্ম ও নিন্ম মধ্য ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোক এফডিআর বা ডাকঘর সঞ্চয়পত্র থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ দিয়ে সংসার চালিয়ে নিতো।
এখন আর পারেনা। দিনকে দিন নিয়ম পাল্টাচ্ছে। এখন সঞ্চয়ের মুনাফার পরিমাণ নিচে নামতে নামতে তলানিতে এসে দাঁড়িয়েছে। নানা রকমের ট্যাক্স ও সার্ভিস চার্জ কেটে নেওয়ার পর সাকুল্যে ৫/৬ পার্সেন্টে নেমেছে। আগামীতে হয়তো মুনাফা দূরে থাক, এফডিআর বা সঞ্চয়পত্রে টাকার রাখার জন্য উল্টো ব্যাংক এবং সরকারকেই প্রতিমাসে টাকা দিতে হবে। এখনই একদিকে সঞ্চয়ের মুনাফা কমছে অপরদিকে বিভিন্ন উসিলায় ট্যাক্স বাড়ছে।
পাচার করা টাকা
বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে, লুটেরাদের নাকি জাতে তোলার জন্য ৭% পার্সেন্ট ট্যাক্স দিয়ে বিদেশে পাচারকৃত হাজার হাজার কোটি টাকা ফেরৎ আনার নামে আরো পাচারের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে! কারা করছে? আগেই বলেছি, যারা সরকার বানায় সরকার ফালায় তারা। তারাই বাজেট বানিয়েছে। জাতীয় সংসদে সেই বাজেট নিয়ে আলোচনা চলছে। সময় থাকলে টেলিভিশনে বাজেট আলোচনা শুনতে পারেন।
একটি দলের লোক সরব থাকে রাজনীতির বদলে ইতিহাসের বিরোধিতা নিয়ে। তারা আর কিছু বুঝে বলে মনে হয় না। অন্যরা যখন যেদিকে বাতাস বয়, সেদিকে কথা কয়। বাজেটে সাধারণ মানুষের কথা বলার লোক নেই। মোদ্দা কথা যারা উচ্চ স্বরে কথা কয়, লুটপাটের জন্য সরকারকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দমক দেয় তাদের খাত থেকে টাকার অংকে কত টাকা পাওয়ার টার্গেট সেটার সহজে বোধগম্য কোন উল্লেখ নেই। কারণ যিনি বাজেট বানিয়েছেন তিনি নিজে এবং তার আশপাশের সবাই বড় মাপের বেনিফিসিয়ারি। তারা জানেন কাদের গলা কেটে সহজে টাকা তুলে নেওয়া যাবে। অথচ কোন শব্দ হবে না।
ঘাটতি ছাড়া বাজেট নাই
মুখে যে যা-ই বলুক এযাবৎকালে এদেশের একটি বাজেটও ঘাটতি ছাড়া হয়নি। কোন অর্থ বছরেই বৈদিশেক সহায়তার কাঙ্ক্ষিত টাকা পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি ধনী লোকদের কাছ থেকে কোন সরকারই সঠিক ট্যাক্স আদায় করতে পারেনি। কারণ ওখানে শেয়ারের কারবার আছে। যারা হিসাব কষে, হিসাব রাখে, হিসাব দেখায় তারাই শেয়ার কারবারি-বেনিফিসিয়ারি।
দেশের সাধারণ মানুষ অর্থনীতির পণ্ডিত নয়। তারা জরিপের মার-প্যাঁচ খুব একটা বুঝে না। মোটা দাগে বুঝে, নিন্ম ও নিন্ম মধ্য শ্রেণির মানুষের সম্বল ‘সঞ্চয়’ লুট না করলেও বাজেট চলবে। জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, বাড়তেই থাকবে। সময়ে সময়ে মুনাফাখোর শ্রেণি ১০ টাকা বাড়িয়ে ২ টাকা কমিয়ে বলবে, ‘সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে’ ব্যবসায়ী সমাজ জিনিসপত্রের দাম কমিয়েছে।
কৃষির গুরুত্ব
বাজেটের ঘাটতি পূরণের নামে নিন্ম ও নিন্মমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সম্বল লুট না করে কৃষির দিকে নজর দেওয়ার কোন বিকল্প নেই। কৃষি খাতের উৎপাদন দ্বিগুণ-তিনগুণ বাড়ানোর বাজেট বানান। তাতে দেশের বিপুলসংখ্যক যুব সমাজ কৃষি কাজের দিকে মনোযোগী হবে। কৃষি উপকরণ বীজ, সার, কীটনাশকসহ সবকিছু আরো সহজলভ্য করতে পারলে শিল্পের জন্য সহায়ক হবে। শিল্পের নামে ব্যাংক লুটের পথ আটকান।
টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ গাজীপুরে কী হচ্ছে দেখুন। ময়মনসিংহের ভালুকা, মুক্তাগাছা, ফুলবাড়িয়া, টাংগাইলে ঘাটাইল, মধুপুর, সখিপুরসহ গাজীপুর আদিভূমির ভূখণ্ড। এসব এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে তেমন কোন ব্যয় হয় না। যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভাল। ফলে এ অঞ্চলের কৃষি জমি বেশুমার লুট হচ্ছে। এসব এলাকার ঊর্বর কৃষিজমি বাউন্ডারি দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। এ অবস্থা শুধু ময়মনসিংহ অঞ্চলেই নয়, গোটা বাংলাদেশেই দেখা যাবে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কৃষিজমিতে শিল্প স্থাপন করলে গ্যাস-বিদ্যুত দেওয়া হবে না। তিনি শিল্প বিরোধী নন। তিনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের দিকে গুরুত্ব দিতে বলেছেন। তাতে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান বাড়বে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকালেও তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, এক ইঞ্চি জমিও যেন পতিত না থাকে। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু তাঁর এই সময়োচিত দূরদর্শী ঘোষণা বাস্তবায়ন হবে কেমনে।
কথায় বলে, ‘চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী’। জনকল্যাণে শুধু সরকার নয়, জনপ্রতিনিধিরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। কারণ, জনপ্রতিনিধিদের নিয়েই গণতান্ত্রিক সরকার হয়। বাজেট অধিবেশনে জনপ্রতিনিধিদের কাছে নিন্ম, নিন্মমধ্য ও মধ্যবিত্তের মানুষ সেটাই প্রত্যাশা করে। আগামী অর্থ বছরের বাজেট উৎপাদন ও কর্মসংস্থানবান্ধব সাধারণ মানুষের বাজেট হলে তার প্রতিফলন জাতীয় নির্বাচনেও দেখা যাবে।
COMMENTS