![]() |
ভূমি মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা থাকা স্বত্তেও নদী ইজারা দেওয়ার পাঁয়তারা করছে পাবনা জেলা প্রশাসন। |
শাহীন রহমান
এনএনবি, পাবনা
ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে পাবনার ১০টি নদীর ৩১টি অংশ জলমহাল
দেখিয়ে মাছ চাষের জন্য ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা প্রশাসন।
গত ১৪ জানুয়ারি, ২০২৪ জেলা প্রশাসক ও জেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি
মু. আসাদুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক নোটিশে ইজারার জন্য মৎস্যজীবীদের কাছ থেকে
দরখাস্ত আহ্বান করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসকের দপ্তরের বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, আগামী তিন বছরের জন্য
জলাশয়গুলো ইজারা দেওয়া হচ্ছে। ইজারার জন্য মোট ৬৩টি জলমহালের কথা উল্লেখ করা
হয়েছে। এর মধ্যে ইছামতী নদীর ১৪টি অংশ, পদ্মা নদীর ৪টি, বড়াল নদের ২টি, চিকনাই
নদের ৩টি, চন্দ্রাবতী নদীর ১টি, আত্রাই নদীর ১টি, গুমানী নদীর নদীর ১টি, রুকনাই
নদীর ১টি, গোহালা নদীর ১টি ও কাগেশ্বরী নদীর ৩টিসহ মোট ১০টি নদীর ৩১টি অংশ
রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট তথ্য মতে, নদী ইজারা দিতে ভূমি মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ২০১০
সালের ১০ মার্চ ওই নিষেধাজ্ঞা দিয়ে জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়েছেন ভূমি
মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব শাহ রেজওয়ান। চিঠিতে ২০১০ সালের ২০ জানুয়ারি ভূমি
মন্ত্রণালয়ের এক সভায় নদী বন্ধ করে যেন মাছ চাষ না করা হয় সেই সিদ্ধান্ত জানানো
হয়। আইন লঙ্ঘন করে নদীগুলোতে মাছ চাষের জন্য ইজারা দেওয়ায় পরিবেশবিদ ও নদী
রক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব মিজানুর
রহমান বলেন, ‘ভূমি মন্ত্রণালয় জেলা প্রশাসকদের চিঠি দেওয়ার পর থেকে পাবনায়
বড়ালসহ সব নদীতে মাছ চাষের জন্য ইজারা দেওয়া বন্ধ ছিল। হঠাৎ করেই এ বছর আবার
মাছ চাষের জন্য ইজারার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।’
মিজানুর রহমান আরও বলেন, ‘নদী উন্মুক্ত জলের উৎস, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান
পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না। তাই আমরা মাছ চাষের জন্য নদী ইজারা
দেওয়ার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। একইসঙ্গে ইজারা বাতিলের জোর দাবি করছি।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) পাবনা জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল
হামিদ খান বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জলমহালের নামে নদী ইজারা দেওয়া মোটেও
কাম্য নয়। মৎস্যজীবীদের নামে জলমহালগুলো স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখলে রাখেন। তারা
নদীর বড় অংশে পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে মাছ চাষ করেন। এতে নদীগুলো মারা
যাচ্ছে। তাই জেলা প্রশাসনের ওই সিদ্ধান্ত আমরা বাতিলের দাবি জানাই।’
ইছামতী রক্ষা আন্দোলন কমিটির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘এমনিতেই ইছামতী নদী
মৃত প্রায়। আমরা নদীটি রক্ষার জন্য দীর্ঘ বছর ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করছি। এর
মধ্যে মাছ চাষের জন্য ইজারা দেওয়া হলে নদীর যে অংশ বেঁচে আছে, সেটুকুও মারা
যাবে।’
মাহবুবুল আলম আরও যোগ করেন, ‘দ্রুত সময়ের মধ্যে ইছামতী নদী উদ্ধারে মহামান্য
রাষ্ট্রপতির প্রচেষ্টায় বর্তমান সরকার একটি বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যেখানে
অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ ও খনন করে নদীর সৌন্দর্য বর্ধন করা হবে। এমন পরিস্থিতিতে
সেখানে কোন প্রক্রিয়ায় ইজারা দেওয়া হবে সেটি পরিষ্কার নয়।’
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও জেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মু.
আসাদুজ্জামান বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের কাছে থাকা রেজিস্ট্রারভুক্ত জলমহালের
তালিকা থেকেই ইজারার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ওই তালিকা আগের। তবে আমরা
সরেজমিনে দেখবো। যে স্থানগুলোতে নদী প্রবহমান রয়েছে, ওই স্থানগুলো ইজারার আওতায়
আসবে না। প্রবহমান জায়গা বাদ দিয়ে ইজারা দেওয়া হবে।’
নদী ইজারা বন্ধে বেলা'র আইনি নোটিশ
এদিকে, নদীকে জলমহাল হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ইজারা দেওয়ার উদ্যোগ স্থগিত করার দাবি
জানিয়ে পাবনার জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট ১২ জনকে আইনী নোটিশ পাঠিয়েছে বাংলাদেশ
পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)।
বেলা'র রাজশাহী বিভাগের সমন্বয়ক তন্ময় কুমার স্যানাল এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন,
‘এ ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা অবহিত করা না হলে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ
আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।’
বেলা’র আইনজীবী জাকিয়া সুলতানা স্বাক্ষরিত ওই নোটিশে বলা হয়, জলমহাল নীতিমালা ও
ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল অনুযায়ী, দেশে দুই ধরনের জলমহাল রয়েছে। বদ্ধ জলমহাল
ও উন্মুক্ত জলমহাল। নদী ও খাল উন্মুক্ত জলমহাল হিসেবে চিহ্নিত। দেশের দরিদ্র
জেলে সম্প্রদায়ের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং তাদের জীবিকা নির্বাহের পথ সুগম করতে
১৯৯৫ সালে স্মারকের মাধ্যমে নদী, খাল ও উন্মুক্ত শ্রেণির সব জলমহালের ইজারা
প্রদান প্রথা বিলুপ্ত করা হয়।
এছাড়া, ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি এবং ওই বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি আদালত রিট নিষ্পত্তি
করে দেশের সব নদীকে লিগ্যাল পারসন/লিগ্যাল এনটিটি/লিভিং এনটিটি ঘোষণা করেন। একই
রায়ে আদালত নদ-নদীসহ উন্মুক্ত সব জলাভূমিকে জনগণের ন্যাস (জনগণের) সম্পত্তি
উল্লেখ করেছেন।
নোটিশে আরও উল্লেখ করা হয়, দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, নদী ও খালকে বদ্ধ
জলমহালে রূপান্তর করার বা বদ্ধ জলমহাল হিসেবে ব্যবহার করার কোনো সুযোগ নেই।
নদী, খাল ও উন্মুক্ত শ্রেণির জলমহালের ইজারা প্রদান প্রথা বিলুপ্ত করা সত্ত্বেও
রাজস্ব আদায়ে নদী ও খালকে বদ্ধ জলমহাল দেখিয়ে ইজারা দেওয়ার কোনো এখতিয়ার জেলা
প্রশাসনের নেই।
তাছাড়া জনগণের সম্পত্তি ইজারা দেওয়া হলে নদীর ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর অধিকার
চরমভাবে লঙ্ঘিত হবে এবং নদীতে অবাধ প্রবেশাধিকার বাধাগ্রস্ত হবে। এটি দেশের
প্রচলিত আইন ও আদালতের আদেশের পরিপন্থি বলেও উল্লেখ করা হয় নোটিশে।
COMMENTS