আমার অতি প্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলন। আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব ইমদাদুল হক মিলন, বন্ধুর মতো বড়ো ভাই। বড়ো ভাইয়ের মতো বন্ধু তিনি। আশ্চর্য ভালো মন ও মধুরতায় তিনি আচ্ছন্ন থাকেন। সারাক্ষণ লেখার মগ্নতায় বুঁদ হয়ে থাকেন। মুখে অমিলন হাসি । খুব রাগ করলেও তিনি উত্তেজিত হন না। হাসির আড়ালে এক ধরনের কপট গাম্ভীর্য থাকে । মিলন ভাই আমাদের খুব প্রিয় মানুষ । মিলন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলেই আমরা কল্লোলিত ও আনন্দিত হয়ে উঠি। মিলন ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা দেয়া আমাদের জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। হাসি আনন্দ পানাহার আড্ডা-সব মিলিয়ে মিলন ভাই মানে শুধুই মিলন ভাই। মিলন ভাই জিনসের প্যান্ট এক রঙের পাঞ্জাবি পরতে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। যৌবনে আধুনিক হাওয়ার ফ্যাশন আইকন ছিলেন। এখন খুব সাধারণ পোশাক পরেন। কিন্তু নিজস্বতা থাকে। জিনসের সঙ্গে ভারী স্যান্ডেল। হাত গুটানো স্লিমফিট পাঞ্জাবি। খুব দৃপ্ত পায়ে হাঁটেন তিনি। হাসিমুখে কথা বলবেন। কথার ভঙ্গিতে বিক্রমপুর এবং পুরানা ঢাকার মিশেলে টান থাকে ।
দেখা হলেই বললেন, কি মিয়া আমীরুল, তোমার কোনো খোঁজখবর নাই। কই থাকো? তুমি তো আবার সাগরের মতো। কখন বিদেশ থাকো, কখন ঢাকায় থাকো কিছুই বুঝা যায় না, বলেই পিঠ চাপড়ে দেবেন। মুচকি হাসি থাকবে ঠোঁটে ।
কী, সাগর আছে?
চলো সাগরের রুমে যাই। একটা গ্রিন টি খাই।
মিলন ভাই খুব স্বল্পাহারী। ভালো খাবার খাবেন। কিন্তু পরিমাণে অল্প। অতিভোজন করেন না। শরীর সচেতন ব্যক্তি। একটু মুটিয়ে গেলেই খুব অস্বস্তিবোধ করেন।
লেখক মিলন ভাই একান্ত সাধক ব্যক্তি। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে লিখতে বসেন। একদম একলব্যের সাধনা। তার অজস্র রচনার পেছনে খেটে খাওয়া মানুষের মতো শ্রম আছে। মিলন ভাই বলেও থাকেন, লেখক হতে হলে স্বাস্থ্য ভালো থাকতে হবে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা ধার করে বলতে হয়- লেখককে মজুর হতে হয়।
মিলন ভাইয়ের খুব প্রিয় লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এ ছাড়াও বাংলা ভাষার প্রধান লেখকদের লেখা মিলন ভাই আদ্যোপান্ত পড়েছেন। বইয়ের নাম, বইয়ের বিষয় তিনি অনর্গল বলতে পারেন আড্ডায় বসলে । মিলন ভাই মুডে থাকলে সেসব বলতে থাকেন । জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, বিমল কর, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, কমলকুমার মজুমদার, সতীনাথ ভাদুড়ী থেকে শুরু করে মানিক, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে নরেন্দ্রনাথ মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ কে নেই মিলন ভাইয়ের পাঠ তালিকায়? কবিতার ব্যাপক পাঠের কথা নাইবা বললাম ।
আমাদের দেশে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ূন আহমেদ, রিজিয়া রহমান, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রাবেয়া খাতুন প্রমুখের লেখা সম্পর্কে জানতে হলে মিলন ভাইয়ের দ্বারস্থ হওয়া সবচেয়ে সোজা। চলমান বিশ্বকোষের মতো মিলন ভাই একনাগাড়ে সবার সম্পর্কে বলে যেতে পারেন।
জীবনের চাওয়া-পাওয়া এবং হিসাব-নিকাশ খুব সহজেই মেনে নিতে পারেন তিনি। খুব প্রত্যাশা নেই জীবনের কাছে। খ্যাতির শীর্ষে থেকেও খ্যাতিকে তুচ্ছজ্ঞান করতে পারেন। স্বার্থপরতা ও প্রত্যাশার বুকে চপেটাঘাত মেরে তিনি সদানন্দ থাকেন।
মিলন ভাই তারকা লেখক। বাঙালি পাঠকের কাছে তিনি অতি বরণীয় লেখক ।
'জনপ্রিয় লেখক'- এই তকমা তিনি লেখক জীবনের শুরু থেকেই বহন করছেন। জীবিকার জন্য নানা রকম পেশায় নিয়োজিত থেকেছেন। এক সময় জার্মানের ফ্রাংকফুটেও কাজ করতেন। প্রবাস জীবনের প্রেক্ষাপটে বেশকিছু আলোচিত উপন্যাস ও ছোটোগল্প লিখেছেন। মিলন ভাইয়ের গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুরের মেদিনীমণ্ডল গ্রামে। এই গ্রামে তার শৈশব কেটেছে সেই স্মৃতি নিয়ে মিলন ভাই প্রচুর গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। তার বৃহৎ আকারের উপন্যাস 'নূরজাহান'ও বিক্রমপুরের পটভূমিকায় লেখা। 'নূরজাহান' উপন্যাসে বিক্রমপুরের অনেক আঞ্চলিক শব্দ অনায়াসে সাহিত্যিক ভাষায় তিনি লিখেছেন। লোকালয় জীবনের অনুষঙ্গ ডিটেল আছে নূরজাহানে। তিনি যে বিশ্বমানের একজন কথাসাহিত্যিক- সেটা উপলব্ধি করা যাবে 'নূরজাহান' পাঠে। কত গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও জীবনবোধ থাকলে এই উপন্যাস লেখা সম্ভব তা কল্পনাও করা যায় না।
সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের আলোচনা করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। গল্প উপন্যাস স্মৃতিগদ্য মুক্তিযুদ্ধ শিশুসাহিত্য-ব্যাপক রচনা। যেন তাঁর রচনাসম্ভার এক বিশাল জলধি। এত বিস্তর রচনাকর্ম বাংলা ভাষায় খুব কমসংখ্যক লেখকের আছে। তার লেখার পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন এখনো হয়নি। সৎ সমালোচকদের দৃষ্টি তিনি অল্প বয়স থেকেই আকর্ষণ করেছেন। দুই বাংলা ছাড়াও বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের কাছে তিনি আদৃত। লন্ডন, নিউইয়র্ক, সিডনি, টোকিও প্রবাসী বাঙালিদের কাছে তিনি স্বপ্নের নায়ক।
ইমদাদুল হক মিলন দীর্ঘদিন ধরে দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক। বড়ো পত্রিকার বড়ো সম্পাদক। মিলন ভাই অতি দক্ষতার সঙ্গে গভীর মনোযোগ দিয়ে সম্পাদনা কর্মে ব্যাপৃত আছেন। কর্মনিষ্ঠায় মিলন ভাই অতুলনীয়।
এই তো দু-এক মাস আগে মিলন ভাইয়ের সঙ্গে কলকাতা গেলাম। সাগর ভাইয়ের লিডারশিপে একদল আমরা। সাগর ভাইয়ের প্রিয়জনেরা এই ট্রিপে ছিলেন। সবাই মিলে গ্র্যান্ড হোটেলে। উদ্দেশ্য-বাহুবলী-২ রিলিজ হচ্ছে একসঙ্গে সেটা দেখা ।
মিলন ভাই কিছুটা পরিহাসমুখর। ফিল্ম দেখা বড়ো ব্যাপার নয়। তোমাদের সঙ্গে আছি এটা বড়ো ব্যাপার। দলে প্রধানত ছিলেন অভিনেতা নির্মাতা আফজাল হোসেন, মাত্রার কর্ণধার সানাউল আরেফিন, ফরিদুর রেজা সাগর, কনা রেজা, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, ফারজানা ব্রাউনিয়া, শহিদুল আলম সাচ্চু, আহমাদ মাযহার আরও অনেকে। বড়ো দল । তাই এই ভ্রমণে অনেক উপদল তৈরি হলো। আমি, ইমদাদুল হক মিলন, আহমাদ মাযহার আর বই বিক্রেতা শাহজাহান। মিলন ভাইকে নিয়ে কোয়েস্ট মলে স্টারমার্কে গেলাম। ইংরেজি বইয়ের ধাক্কায় কলকাতাতেই বাংলা বই কোণঠাসা হয়ে গেছে। মিলন ভাই বেদনা প্রকাশ করলেন। তাঁকে নিয়ে গেলাম ফোরাম শপিংমলের পাশে বুক স্টোরি দোকানে। ওখানে মিলন ভাইয়ের কয়েকজন ভক্তের সঙ্গে দেখা। ফোরামের ভেতরে এক বিশাল বারে বসে গল্প করে সময় কাটালাম। আড্ডা আর পানাহার। একটি বাণিজ্যিক সিনেমা বাহুবলি-২। সবাই মিলে দেখছি। মিলন ভাই ছবিটার কোনো সমালোচনা করলেন না। বরং এর বাণিজ্যিক উপকরণ নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। বাণিজ্যিক সিনেমার সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ক নাই। মিলন ভাই এটা বুঝিয়ে দিলেন আমাদের । কিন্তু সিনেমার আনন্দ রস উপভোগে তাঁর কার্পণ্য নাই। এর আগেও মিলন ভাইয়ের সঙ্গে কলকাতার বইমেলায় গেছি।
অনেক সম্মানিত লেখক তিনি কলকাতায়। আনন্দ প্রকাশনে যখন যান তখন যেন সাহিত্যের যুবরাজের প্রবেশ ঘটে কলেজ স্ট্রিটে। আমাদের প্রিয় শিশুসাহিত্যিক আলী ইমাম, মিলন ভাইয়ের খুব ভক্ত। মিলন ভাইকে তিনি সম্বোধন করেন সাহিত্যের যুবরাজ হিসেবে। মিলন ভাই অসাধারণ বাগ্মী। সাহিত্য বিষয়ে খুবই সুন্দর বক্তৃতা দেন।
অনেক গভীর কথা খুব সহজভাবে বলতে পারেন।
মিলন ভাই রবীন্দ্র সঙ্গীতের খুব ভক্ত। চ্যানেল আইতে বন্যাদির গানের অনুষ্ঠান প্রযোজনা করেছিলাম মিলন ভাইয়ের উপস্থাপনায়। কী যে আশ্চর্য- সুন্দর উপস্থাপনা! সেই ভালো লাগা আমি লিখে বোঝাতে পারব না। টেলিভিশনে এক সময় নিয়মিত নানা ধরনের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন। এনটিভিতে প্রচারিত ‘কী কথা তাহার সাথে' অনুষ্ঠানটি এখন ইতিহাস হয়ে গেছে। ‘কালের কণ্ঠ' সম্পাদকের ব্যস্ততার কারণে মিলন ভাই এখন উপস্থাপক জীবন থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসিত।
মিলন ভাই দুই কন্যা সন্তানের পিতা। একা ও লেখা। মিলন ভাই লেখাকে খুব ভালোবাসেন। অসম্ভব মেধাবী মেয়ে। মেয়েও পিতা অন্তঃপ্রাণ। মিলন ভাইয়ের আরেক পুত্র আছে। সে আরেক উপাখ্যান। পুত্রের গল্প আরেক লেখায় বলা যাবে।
পরিবেশ ও মনের মতো সঙ্গী হলে মিলন ভাই নিজেকে উন্মুক্ত করে আড্ডা দিতে ভালোবাসেন। বিপুল পঠন-পাঠন ও জীবন অভিজ্ঞতার গল্প শুনতে শুনতে বিস্মিত হতে হয়। আড্ডায় মিলন ভাই কিংবদন্তিতুল্য চরিত্র। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে, অনন্যা প্রকাশনী বা সময় প্রকাশনে, চ্যানেল আইতে, শাহবাগে, বাসায়, লিলিদির বাসায় কত যে আড্ডা দিয়েছি তার হিসাব নাই। বাংলা একাডেমি বইমেলায় আড্ডা তো এখনও জীবন্ত স্মৃতি হয়ে আছে।
মিলন ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকার বাইরেও অনেক সাহিত্য অনুষ্ঠানে গিয়েছি। দেখেছি- সাধারণ লেখকদের সঙ্গেও কত আন্তরিকভাবে তিনি মেলামেশা করেন। মানুষের মূল্য দেন তিনি। ছোটো বড়ো বিভাজন করেন না তিনি। তাই তিনি মহৎ লোক। বড়ো মানুষ এবং বড়ো লেখক বলেই আমরা মিলন ভাইয়ের তীব্র ভক্ত।
লেখক: কবি, ছড়াকার, কথাশিল্পী ও গবেষক ।
COMMENTS