![]() |
ছবি: সংগৃহীত |
এনএনবি, পাবনা
পাবনা সদর থানার হেমায়েতপুর ইউনিয়নের হেমায়েতপুর গ্রামে শ্রী শ্রী ঠাকুর
অনুকূলচন্দ্র সৎসঙ্গ আশ্রমের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও জেলা যুবলীগের সদস্য
সৌহার্দ্য বসাক সুমনের বিরুদ্ধে আধিপত্য বিস্তার, ক্ষমতার অপব্যবহার, আশ্রম
সংশ্লিষ্টদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করা, জোরপূর্বক অর্থ ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
ছিনিয়ে নেওয়া, বিলাস বহুল কক্ষ দখল করে মদের আসর বসানোসহ নানা অভিযোগ উঠেছে।
একাধিক আশ্রম কর্মী ও কর্মকর্তাদের অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রভাবের শিকার আশ্রম
পরিপন্থি নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর থেকে পাবনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম
ফারুক প্রিন্সের অনুসারীরা আশ্রমের উপর খবরদারি শুরু করেন। এর ফলস্বরূপ,
আশ্রমের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য যুবলীগ নেতা সৌহার্দ্য বসাক সুমন একের পর এক
অনিয়ম অব্যাহত রেখেছেন। সুমনের আধিপত্য বিস্তার ও হুমকি ধামকির বিষয়ে প্রশাসনসহ
কাউকে জানালে প্রাণনাশের হুমকিও দিচ্ছেন তিনি।
তথ্যানুসন্ধান ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১১ মার্চ, ২০২৪ পাবনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য
গোলাম ফারুক প্রিন্স কর্তৃক গঠন করা হেমায়েতপুরের সৎসঙ্গের আহ্বায়ক কমিটির
সদস্য হয়ে সৌহার্দ্য বসাক সুমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। ইতোমধ্যে তিনি আশ্রমের
লক্ষাধিক টাকা দিয়ে আশ্রমের ৫ম তলায় নিজের জন্য একটি কক্ষ বিলাস বহুলভাবে
সাজিয়ে নিজের চেম্বার বানিয়েছেন। সেখানে তিনি আশ্রমের টাকায় কেনা আশ্রমের মধ্যে
সব থেকে দামি চেয়ার, দামি টেবিল, দামি কার্পেট ব্যবহার করেন। বিকেলের পর থেকে
আশ্রমের ৫ম তলায় বিলাস বহুল অফিস কক্ষে মদের আসরসহ অসৎ উদ্দেশ্যে অবস্থান করেন
সুমন।
এর নেপথ্যে ইন্ধন দিচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগ নেতা শাহজাহান মামুন, পাবনা পৌরসভার
ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহীন ও রাজিব। সুমন নিজেকে আশ্রমের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী
দাবি করে ইচ্ছা মতো নির্দেশ দেওয়া শুরু করেছেন। সুমনের কথামতো না চললে আশ্রমের
একাধিক কর্মীকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন সুমন। তার হুমকিতে কয়েকজন কর্মী কাজ ছেড়ে
আশ্রম ত্যাগ করেছেন বলে জানা গেছে। সুমনের দাপটে আশ্রমের অনেকেই এখন
ভীতসন্ত্রস্ত। আশ্রমের অর্থের দখলও নিয়েছেন সুমন।
আশ্রমের ক্যাশিয়ার সুনীল রায় জানান, সৌহার্দ্য বসাক সুমনের অনুমতি ছাড়া ক্যাশ
থেকে টাকা উত্তোলন করা নিষেধ। সুমন গত ২০ দিনে আশ্রমের লক্ষ লক্ষ টাকার মালামাল
ক্রয় ও আশ্রমের উৎপাদিত প্রায় ৮০ মণ শস্য বিক্রি করেছেন। আশ্রমের প্রয়োজনীয়
জিনিসপত্র ক্রয়-বিক্রয় এখন সরাসরি সুমনের মাধ্যমে হয় বলেও জানান আশ্রমের ক্যাশিয়ার।
তিনি বলেন, ‘সুমন বসাকের পাবনা শহরে একটা স্বর্ণের দোকান রয়েছে। ঈদের বাজারে
সুমন দোকানে সময় না দিয়ে প্রতিদিন অনুকূল ঠাকুরের আশ্রমে এসে সমস্ত বিষয়ের
খবরদারি করে আশ্রম থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। সুমনের প্রধান আয়ের উৎস
এখন অনুকূল ঠাকুরের আশ্রম।’
আশ্রমের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্যের করা আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব তাপস
চন্দ্র বর্মণ জানান, ‘কমিটির নেওয়া সিদ্ধান্ত ও ক্যাশিয়ারের নিকট অর্থ প্রদান
সংক্রান্ত আমার আদেশ এই সুমন বসাক আটকে দিয়ে দেশের শাখা মন্দিরের উন্নয়ন কাজে
বাঁধা সৃষ্টি করছেন। সুমন বসাক আশ্রম কর্মীদের মধ্যে ভীতিকর পরিবেশ
তৈরি করছেন।’
সুমন বসাকের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে তার পক্ষে আশ্রমে দায়িত্ব পালন করা
সম্ভব না বলে তাপস চন্দ্র বর্মণ জানান।
তিনি বলেন, ‘এই ক’দিনেই সুমনের দাপটে আশ্রম কমিটির সদস্য, পুরোহিত সাধারণ
ভক্ত সবাই অসহায়। সুমন বসাক নিজেকে এমপি প্রিন্সের আস্থাভাজন ব্যক্তি প্রচার
করে কমিটির সিদ্ধান্ত ছাড়া আশ্রমের কর্মকর্তাদের নেমপ্লেট খুলে ফেলেছেন। এছাড়া
এমপি প্রিন্সের নাম ভাঙিয়ে আশ্রমের আর্থিক ভাউচারে স্বাক্ষর করা, আশ্রম
কর্মীদের ছুটি প্রদান, আশ্রমে যাবতীয় ক্রয়, বিক্রয়সহ নিজেকে আশ্রমের সর্বময়
কর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে উঠে পড়ে লেগেছেন।’
অভিযোগের বিষয়ে পাবনা পৌরসভার কাউন্সিলর শাহীন শেখ বলেন, ‘আশ্রম
শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালনার জন্য এমপি সাহেব উভয়পক্ষের সাথে সমঝোতা করেই একটি
আহ্বায়ক কমিটি গঠনের কথা বলেছেন। তার নির্দেশনায় আমরা এই কমিটি করে দিয়েছি। আমরা
চাই ঠাকুরের এই প্রতিষ্ঠান সুন্দরভাবে পরিচালিত হোক।’
সুমন বসাকের সাথে যোগসাজশে আর্থিক অনিয়মসহ প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে শাহীন শেখ
বলেন, ‘এ কথাগুলো সঠিক নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে আশ্রমের কোন কর্মকাণ্ডে বাধা
প্রদান করা বা প্রভাব বিস্তার করা আদৌ সঠিক নয়। কেউ যদি এমন অনৈতিক কর্মকাণ্ড করে তাহলে সে দায়ভার তাকেই নিতে হবে।’
অভিযোগের বিষয়ে যুবলীগ নেতা সৌহার্দ্য বসাক সুমন বলেন, ‘এসব অভিযোগ সত্য নয়। বরং
বিভিন্ন অনিয়মের প্রতিবাদ করার কারণে আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ তোলা হচ্ছে।
বিভিন্ন খরচের ভাউচারে অনিয়ন্ত্রিতভাবে খরচ দেখানো হয়েছে। যা অবিশ্বাস্য। অথচ
আমার নামে কোনো ভাউচার দেখাতে পারবেন না।’
বিলাস বহুল কক্ষের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তাদের বলেছিলাম যেহেতু আমি ২৯ সদস্য কমিটির একজন। আশ্রমে আসি।
তাই আমাকে একটা বসার জায়গা করে দিয়েন। তারাই আমাকে ৫তম তলার একটি কক্ষ দিয়েছে।
আসবাবপত্র তারাই কিনেছে। সেখানে লাখ টাকার আসবাবপত্র নেই। কাউকে হুমকি ধামকি
দেওয়ার প্রশ্ন অবান্তর। কারণ আশ্রমের কর্মীদের কাছে জেনে দেখেন আমি কাউকে হুমকি
দিয়েছি কি না। আসলে আমি তাদের অনিয়ম দুর্নীতিতে বাধা দেয়ায় আমার উপর ক্ষিপ্ত
হয়ে মিথ্যা অভিযোগ করছে।’
এ বিষয়ে জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক আলী মুর্তজা বিশ্বাস সনির দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে
তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নাই। আশ্রম কর্তৃপক্ষও আমাদেরকে এ বিষয়ে কিছু
জানায়নি। আশ্রম কর্তৃপক্ষ যদি আমাদেরকে এ বিষয়টি জানায় তাহলে আমরা সেই অনুযায়ী
ব্যবস্থা নেবো। যেহেতু এটি একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। সেখানে আমাদের দলীয় কেউ
গিয়ে সেখানে বিশৃঙ্খলা করলে অবশ্যই আমরা বিষয়টি দেখবো।’
এ ব্যাপারে পাবনা-৫ সদর আসনের সংসদ সদস্য, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক
গোলাম ফারুক প্রিন্সের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র
আশ্রম একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও পবিত্র জায়গা। সেখানকার শান্তি-শৃঙ্খলা বজায়
রাখার স্বার্থে আমরা সেখানে দুই পক্ষকে নিয়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দিয়েছি।
সেখানে কোন অনিয়ম বা প্রভাব বিস্তারের সুযোগ নেই। আপনারা আশ্রম কর্তৃপক্ষের
সাথে কথা বলেন। আশ্রম কর্তৃপক্ষ অবশ্য আমাকে এ বিষয়ে কোন কিছু অবহিত করেনি। তবে
যদি সে এরকম কোন কর্মকাণ্ড করে থাকে তাহলে তার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
প্রসঙ্গত, যুবলীগ নেতা নামধারী সৌহার্দ্য বসাক সুমন গত ২০১৬ সালে পাবনা বিশেষ দায়রা জজ আদালতের জীবন কুমার সূত্রধর হত্যা মামলায় প্রধান আসামি হিসেবে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সুমন জেল না খেটে পাবনা শহরের বিভিন্ন এলাকায় নানা অপকর্ম করে চলেছেন।
এ ছাড়া ২০২২ সালে অবৈধ যৌন উত্তেজক সিরাপ বানানো ও বিক্রির দায়ে জেলা গোয়েন্দা সংস্থার জালে ধরা পড়েছিলেন সুমন। বিভিন্ন অপকর্মের কারণে কয়েক দফা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখোমুখি হতে হয়েছে এই সুমনকে। বারবারই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রভাবশালীদের সাহায্যে মুক্ত হন সুমন। সর্বশেষ সুমন বসাকের অশুভ হস্তক্ষেপের শিকার হয়েছে মহামানব ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত পাবনার হেমায়েতপুরের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ঐতিহ্যবাহী সৎসঙ্গ আশ্রম।
COMMENTS